Tuesday, June 23, 2020

যেভাবে ক্রুসেডের কঠিন জবাব দিয়েছিল মুসলিমরা (The way Muslims responded by the Crusades had a strong answer)

Crusades picture


খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের অধিপতি পোপ দ্বিতীয় আরবানের সময় ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মতো মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করে ইউরোপীয় ক্রুসেডাররা। তৎকালীন খ্রিস্টানদের দৃষ্টিতে এই ‘পবিত্র যুদ্ধ’ শেষ হয় ১২৯১ সালে। বারো শতকের একেবারে শুরুর দিকে শুধু পবিত্র নগরী জেরুজালেমই নয়, মুসলিম অধ্যুষিত লেভান্ট (ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক, মিসর, লেবানন, জর্দান, ফিলিস্তিন) অঞ্চলের বিরাট একটি অংশ দখলে নেয় ক্রুসেডাররা। এই সময়েই ক্রুসেডারদের হাতে চলে যায় ইসলামের তৃতীয় পবিত্র ধর্মীয় স্থান আল-আকসা।

বিরাট এই অঞ্চলের দখল এর আগে চারশো বছর ধরে বিশ্ব ক্ষমতায় থাকা মুসলিমদের মর্মাহত করে তোলে। জেরুজালেম দখলে নিয়ে ভূখণ্ড শাসনে নতুন ব্যবস্থা চালু করে ক্রুসেডাররা (Crusades)। স্থানীয় মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের নিজ ভূমি থেকে উৎখাত করে তারা। পশ্চিম ইউরোপ থেকে অভিবাসী এনে তাদের স্থায়ী আবাস গড়ে।

মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আফাফ সাবরা বলেন, ‘ওই সমস্ত মানুষজন ছিল দাস ও ভূমিদাস শ্রেণী থেকে আসা। ইউরোপে তাদের কোনো অধিকার ছিল না।

তারা যখন আমাদের এখানে এলো, তারা ভূস্বামী হয়ে উঠলো, তাদের জীবন পাল্টে গেলো। তাদের সামাজিক অবস্থা বদলে গেলো। ফলে জনসংখ্যা ও সামাজিক স্তরবিন্যাসও পাল্টে গেলো।’

শুধু তাই নয়, প্রথম ক্রুসেডের কমান্ডাররা- ইউরোপে যারা নিম্ন শ্রেণীর যোদ্ধা ছিল- তারা দখলকৃত ভূখণ্ডে রাজকীয়ভাবে চলাফেরা শুরু করলো। ১১০০ সালের জুলাই মাসে প্রথম ক্রুসেডের (Crusades) অন্যতম নেতা বোলজোনার বাল্ডউইনকে জেরুজালেমের সম্রাট ঘোষণা করা হয়।

জাকাজিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কাসেম আবদু কাসেম বলেন, ‘জেরুজালেমে রাজতন্ত্র স্থাপনের ফলে এডেসা ও অ্যান্টিঅকের (রোমান ভূখণ্ড) জন্য আরব ভূমিতে আসা সহজ হয়ে যায়। নতুন উপনিবেশবাদী নেতারা খুব সহজেই তাদের রাজত্ব বাড়াতে থাকে।

এক দশকের মধ্যেই লেভান্ট উপকূলের বেশিরভাগ ক্রুসেডারদের হাতে চলে যায়। পূর্বাঞ্চলে খ্রিস্টান ছিটমহলের সংখ্যা দাঁড়ায় চারে। এর সঙ্গে ত্রিপোলিও (বর্তমান লিবিয়ার রাজধানী) দখল করে তারা।

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টের ইতিহাস বিভাগের গবেষক জ্যান ভেন্ডেবুরি বলেন, ‘উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ছিল ক্রুসেডারদের জন্য অত্যন্ত অত্যন্ত কৌশলগত স্থান- খাদ্য সরবরাহের জন্যও, তীর্থযাত্রী পরিবহণের জন্যও। সুতরাং উপকূলীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ক্রুসেডারদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’

যুদ্ধপরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে ক্রুসেডেররা (Crusades) লাভবান হতে শুরু করে। তারা তাদের বাহিনী নিয়ে লেভান্টের তৎকালীন রাজধানী আলেপ্পোর দিকে যাত্রা করে।

সেই সময়ে আলেপ্পোর শাসক ছিলেন রেদওয়ান, যাকে বলা হতো, ‘মেরুদণ্ডহীন, ‘চাটুকার’ শাসক। ক্রুসেডারদের সঙ্গে সখ্য ছিল তার। তার ব্যাপারে এমন কথাও প্রচলিত আছে, আলেপ্পো মসজিদে খ্রিস্টানদের ক্রুশ ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় স্থানীয় মুসলিমদের মধ্যে। অনেকেই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

এই বিদ্রোহ ছিল অপ্রতিরোধ্য। দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও তারা বাগদাদের খলিফার কাছে এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপের দাবি জানায়। আব্বাসীয় খলিফা আল-মুস্তাজহির সেলজুক সুলতানদের কাছে সাহায্য চান।

মসুলের গভর্নর মওদুদকে আদেশ দেয়া হয় তার বাহিনী জড়ো করে ক্রুসেডারদের আলেপ্পো দখল প্রতিহত করতে। এতে সফল হন তিনি। আপাতত ক্রুসেডারদের হাত থেকে শহরটি রক্ষা করা গেলেও রেদওয়ানের বাহিনীর বাধার মুখে এর ভেতরে প্রবেশ করা যায়নি।

সাবরা বলেন, ‘এই সময়েই দামেস্কের গভর্নর তোঘতেইন জেরুজালেম রাজত্বের আক্রমণের শিকার হন। তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে মওদুদের বাহিনী। আস-সানাবার যুদ্ধে বাল্ডউইনের বাহিনীর মুখোমুখি হয় মওদুদের বাহিনী। এতে শেষ পর্যন্ত মুসলিমদের হাতে ক্রুসেডাররা পরাজিত হয়।’

সারজাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মুহাম্মদ মোনেস আওয়াদ বলেন, ‘মুসলিমদের প্রতিহত করতে ক্রুসেডাররা তাদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করে রাখতো। এজন্য দায়ী ছিল অজ্ঞ মুসলিম শাসকরা। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে মুসলিমের জন্য একটি একক ফ্রন্ট তৈরি হলো।’

এতদিন ধরে জেরুজালেমের সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি চলছিল দামেস্কের। ইমাদুদ্দিন জেঙ্গি নতুন করে সেনা অভিযানের প্রস্তুতি নিলেন। ১১৪৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর তার সেনাবাহিনী এডেসা আক্রমণ করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এই প্রথম ক্রুসেডারদের কোনো রাজ্য মুসলিমদের অধীনে এলো।

ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক জোনাথন ফিলিপস বলেন, ‘এটি ছিল একটি বড় উত্তরণ। প্রকৃত সূচনা। ওই অঞ্চলের মুসলিমদের মধ্যে ‘জিহাদের’ পুনরুজ্জীবন। ক্রুসেডারদের (Crusades) জন্য এটি একটি বড় পরাজয়। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, তারাও পরাজিত হতে পারে এবং মুসলিমদের পুনরুজ্জীবন সম্ভব।’ 

0 comments:

Post a Comment